শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬

প্রাগৈতিহাসিক পর্ব ১: প্রাচীন প্রস্তর যুগে তাম্রলিপ্ত

এই সেই বিশাল মহাবিশ্বের খানিক অংশের ছবি, খুব কষ্ট করে খোজার চেষ্টা করলে হয়তো পেতে পারেন একটি ধূসর নীল বিন্দু, আমাদের পৃথিবী, আমাদের যাবতীয় অহংকার, গর্ব, ইতিহাস, দর্শন, জয় পরাজয়, ঘৃণা, সবকিছু, সবকিছুই রয়েছে এই ছোট্ট নীল বিন্দুতে, মহাজাগতিক সময়ের তুলনায় কিছু মূহুর্তের জন্য।
মহাবিশ্ব পৃূথিবী থেকে
370 কোটি মাইল দূর  থেকে পৃথিবীর তোলা ছবি

বিজ্ঞানী
রা ধারনা দেওয়ার জন্য মহাজাগতিক সময়কে এক বছর ধরে সুন্দর একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছে, যেখানে এক সেকেন্ড মানে ৪৩৭.৫  বছর, এক ঘন্টা মানে ১৫.৭৫ লক্ষ বছর, একদিন মানে সাইত্রিশ কোটি আশি লক্ষ বছর।
কসমিক ক্যালেন্ডার 

এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি রাত ১২ টায় বিগব্যাং বা মহা বিস্ফারণ এর মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্ব তৈরি শুরু হয়েছিল, মে মাসে তৈরি হল ছায়াপথ, সেপ্টেম্বরে তৈরি হল আমাদের এই সৌরমণ্ডল ও পৃথিবী, অক্টোবর মাসে পৃথিবীতে এল সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতি, ডিসেম্বরের ২০ তারিখে জলে এল মাছ, ২৫ তারিখ এল ডাইনোসরেরা,৩০ তারিখ ডাইনোসরেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়, ৩১ তারিখ রাত ১১টা ৫২ মিনিটে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়। ১১টা ৫৯ অব্দি ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া চলে। এবং যাবতীয় কৃষিকাজ উদ্ভাবন, বাসস্থান তৈরি,  যুদ্ধ বিগ্রহ, টেকনোলজির আবিষ্কার ঘটেছে এই শেষ এক মিনিটে। আপনার আয়ুষ্কাল এই মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারে মাত্র ০.২৩ সেকেন্ড, চোখের পলক মাত্র!
পৃথিবী সৃষ্টির মুহূর্তে
প্রথম পর্যায়ে পৃথিবীর মানচিত্র আজকের মত ছিল না। চারশত চুয়ান্ন কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরির সময় ছিল জ্বলন্ত গ্যাসের পিন্ড, ক্রমে উপরের তল তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয় এবং অনেকটা দুধে সর পড়ার মত করে বাইরের আবরণ তৈরি হয়। সমগ্র ভূতল শেষবারের মতো একসাথে যুক্ত ছিল ২৪ কোটি বছর আগে, যার নাম ছিল প্যাঞ্জিয়া। এই প্যাঞ্জিয়ার দক্ষিণ অংশের নাম ছিল গন্ডোয়ানা,উত্তর অংশ লরেশিয়া। কিন্তু পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর প্রতিদিন একচক্কর সম্পূর্ণ করে, ফলে অপকেন্দ্র বলের প্রভাবে গরম লাভার উপরে ভাসমান ভূপৃষ্ঠ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গন্ডোয়ানা প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে ভাংতে শুরু করে, তখন স্থলভাগ দাপিয়ে বেড়চ্ছে ডাইনোসরেরা। একটি অংশ চলে যায় আরো দক্ষিণে,যাকে এখন চিনি আন্টার্টিকা হিসেবে, একটি অংশ চলে যায় পূর্বের দিকে,যা পরিচিত অষ্ট্রেলিয়া নামে, একটি অংশ চলে যায় পশ্চিমের দিকে,নাম হয় দক্ষিণ আমেরিকা, আরেকটি অংশ ভারত মহাসাগর ধরে পাড়ি দেয় সুদূর উত্তরে,যা পরিচিত ভারতবর্ষ হিসেবে। ৪.৫ কোটি বছর আগে এই গন্ডোয়ানার অংশ বা ভারত ভূখণ্ড এসে ধাক্কা মারে উত্তরের ইউরেশিয়া প্লেটকে। সংঘর্ষস্থলে জন্ম নেয় হিমালয় পর্বতমালা। তৈরি হল নদী, গংগা,সিন্ধু,ব্রম্ভ্রপুত্র। হিমালয়ের বিপুল পলিমাটি নিয়ে এসে এই ন্দীগুলো জমা করতে থাকে নদীখাতে। তৈরি করলো বিশাল সব সমভূমি। আমাদের তমলুক তথা তাম্রলিপ্ত এই গন্ডোয়ানারই অংশ, গাংগেয় সমভূমির উপরে গড়ে উঠেছে।
প্যানজিয়া থেকে ভারতের যাত্রা 

এবারে আসা যাক তাম্রলিপ্ত তথা ভারতবর্ষতে আধুনিক মানুষের আগমন প্রসংগে। ৩৫৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব হয়। এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীব হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়। বিবর্তনের ধারা বেয়ে অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণী হয়ে আসে উভচর প্রাণী, সরীসৃপ প্রাণী ও সবশেষে আসে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে আসে  মহাবানরেরা (হোমিনিড), প্রায় সাড়ে আট কোটি বছর আগে, আমাদের আদিপুরুষেরা।
জীবজগতের  বিবর্তন

মানুষের বিবর্তন
আধুনিক মানুষকে বিজ্ঞনীরা ডাকেন হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স নামে। আমাদের সদ্য পূর্বপুরুষরা ছিল হোমো ইরেক্টাস, জন্মস্থান ছিল আফ্রিকা মহাদেশ, অন্তত ১৭ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে তারা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবী নানা সময়েই অত্যন্ত গরম হয়েছে, কখনো বা অত্যন্ত শীতল, সেইমতো প্রচণ্ড খাদ্যসংকট দেখা দেয়, যা তাদের বাধ্য করে নতুন বাসস্থান খুজে বের করতে। এই হোমো ইরেক্টাসরা দুপায়ে হাটতে পারতো, পাথরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো, আগুন জ্বালাতে পারতো,মাংস ঝলসে খেতো। প্রাচীন প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটে এদেরই হাত ধরে।
ক্রমশঃ এরা বিবর্তিত হতে শুরু করে আফ্রিকার চরম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য, আসে হোমো হাইডেলবার্গেনসিস,প্রায় ৬ লক্ষ বছর আগে। এশিয়ায় পরিবেশ এত ঘন ঘন পরিবর্তন হয়নি,ফলে এখানে ইরেক্টাসরা আর বিবর্তিত হয়নি ও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

হোমো ইরেক্টাস ও তাদের যাত্রাপথ

হাইডেলবার্গেনসিসরাও আফ্রিকা ছেড়ে পাড়ি দেয় এশিয়া এবং ইউরোপে। সেই সাথে সহানুভূতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা এরা ধীরে ধীরে রপ্ত করতে শুরু করে, লাল আকর ব্যবহার করে গুহাচিত্র আকা এরাই প্রথম শুরু করে। 
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস ও গুহাচিত্র


বেচে থাকার লড়াইতে হাইডেলবার্গেনসিসরাও বিবর্তিত হয়। এই সময় জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনে আফ্রিকার উত্তরে সাহারা মরুভূমি তৈরি হয়, যা ইউরোপ আর আফ্রিকাকে আলাদা করে দেয়। ফলে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় হোমো সেপিয়েন্স, ইউরোপে তৈরি হয় হোমো নিয়ান্ডার্থাল, এশিয়াতেও পৃথক বিবর্তন ঘটে,তৈরি হয় ডেনিসোভিয়ান। প্রায় একলক্ষ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে বাইরেও রওনা দেয়। বাকি প্রজাতিদের সাথে আন্তঃপ্রজননও ঘটে। আমরা আজও এই তিনপ্রজাতির বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছি,যদিও হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স ছাড়া বাকিরা বিলুপ্ত হয়ে যায় সেই দশহাজার বছর আগে।
হোমো নিয়ান্ডার্থাল ও  হোমো সেপিয়েন্স

পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন সময়ে যাত্রাপথ
আফ্রিকা থেকে এশিয়াতে আধুনিক মানুষের রওনা দুভাবে দিয়েছে, প্রথমটি ঘটে লোহিত সাগর পেরিয়ে জলপথ ধরে দক্ষিণ ভারত ধরে অষ্ট্রেলিয়ায় (এদেরই একটি অংশ অবিকৃত অবস্থায় আজও রয়েছে আন্দামানে), পরেরটি ঘটে স্থলপথে সুয়েজ পেরিয়ে চীন হয়ে ভারতে আগমন। ভারতে হোমো সেপিয়েন্স আসে প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে।
আধুনিক মানুষের দুই যাত্রাপথ

আমরা বিশেষ নজর রাখবো,যারা জলপথে ভারতে এসেছিল, তারা নৌবিদ্যায় বিশেষ দক্ষ ছিল এবং তাদের যাত্রাপথে স্পষ্টতই তাম্রলিপ্ত পড়ছে। তাম্রলিপ্তর আদি বসতি গড়ে উঠেছিল এদেরই হাত ধরেই, অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসিন্দাদের সাথে তাই ভারতে থেকে যাওয়া জনজাতির অদ্ভুত জিনের মিল পাওয়া যায় (পরের কোনো লেখায় জানাবো ভারতে কোন জনজাতি)। আজও মেদিনীপুর এর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (বিশেষত গেওয়াখালির অদূরে নাটশাল গ্রাম থেকে) প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়ে চলেছে,যাদের মধ্যে আছে কাটারি, হাত কুঠার ইত্যাদি। খাদ্য সংগ্রহ আর শিকার করেই তখনকার মানুষদের বেচে থাকতে হত। তমলুক মিউজিয়ামে আজও উদ্ধার হওয়া প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্রগুলো গেলে দেখতে পাওয়া যাবে।
এরকম ধরনের নৌকা নিয়েই আমাদের পূর্বপূরুষরা প্রথম সমুদ্রে রওনা দিয়েছিলেন
প্রাচী প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র
 প্রাচীন প্রস্তর যুগের বসতি

(চলবে)



সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

তাম্রলিপ্ত নামকরণের ইতিহাস

আগের লেখাতেই আমরা দেখেছি তাম্রলিপ্তের বহু নাম, আসলে সেই প্রাক সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে এখানে বসতি, জনপদ বা সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে এখানে মানুষ থেকেছে। এই জনপদের আয়তনও কম ছিল না,আধুনিক তমলুক শহর এর একটি অংশ মাত্র।
সমস্যা হল প্রাচীন কোনো স্থানীয় বিবরণের ইতিহাস এখনো পাওয়া যায়নি। তাই আমাদের নির্ভর করতে হয় সমসাময়িক অন্যান্য সাহিত্য বা বিভিন্ন সময়ে আসা পর্যটকদের উপর।
আমরা পাড়ি দেবো তমলুকের প্রাগতৈহাসিক যুগে,কিন্তু তার আগে এই লেখায় থাকলো তমলুকের নামকরণের ইতিহাস।
ষোড়শ শতকের প্রাচীন ভৌগলিক গ্রন্থ 'দিগ্বিজয় প্রকাশে' নামকরণ এর নেপথ্যে একটি গল্প আছে। যখন বৃন্দাবনে বাসুদেব রামলীলা করছিলেন, সে সময় তার ইচ্ছেতে চন্দ্র সূর্যের স্তম্ভন হয়েছিল, মানে দিনরাত্রির গতি থামিয়ে দিয়েছিল। পরে সূর্যদেব সারথিকে বলেছিলেন আমি ভারতকে দিন করবো,তুমি উদয়াচল থেকে তাড়াতাড়ি এসো। সারথি রশ্মি নিয়ে এলে জ্যোতস্না চলে গেলো, সূর্যরশ্মি (তাম্রবর্ণ) দূর হতে সমুদ্রপ্রান্তে পড়লো, যেখানে পড়লো,তার নাম হল তাম্রলিপ্ত। প্রসংগত, নানা লেখা থেকে বোঝা যায় তাম্রলিপ্ত ছিল সেই সময় হুগলী নদীর মোহনায়, পূর্বতম প্রান্তে প্রথম বন্দর। তাই প্রথম সূর্যরশ্মি এখানেই পড়বে,স্বাভাবিক।
আবার অন্য একটি প্রাচীন বৈষ্ণব পুথি থেকে জানা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসলীলায় মগ্ন ছিলেন,তখন সূর্যদেব পূর্বদিক থেকে উদয় হন এবং শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধিকার সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে লজ্জা পেয়ে তাম্রবর্ণ এর রশ্মি বিকিরণ করে পূর্বদিকে বংগোপসাগরে লুকিয়ে(লিপ্ত হন) যান। এই জায়গাটির নাম হয় তাম্রলিপ্ত।
বলা বাহুল্য ষোড়শ শতক থেকে তমলুকে বিষ্ণু ধর্ম ভালোমতই প্রতিষ্ঠিত,তাই পরবর্তী সময়ে নামকরণ এর নেপথ্যে কৃষ্ণ এর নাম বারবার এসেছে,এমনকি তমলুকের অন্যনাম তাই বিষ্ণুগৃহ।
মহাভারতে নানা অধ্যায়ে আমরা বারবার তাম্রলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাই এবং বর্ননা অনুসারে এখানে রাজা ছিলেন তাম্রধ্বজ। স্থানীয় মতে এই তাম্রধ্বজ রাজার নাম থেকেই তাম্রলিপ্ত নাম হয়েছে।
তবে তাম্রলিপ্ত নামের সম্ভাব্য কারণ তামা। তাম্রযুগে অর্থাৎ সিন্ধুসভ্যতার সময়ে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকেই তামা উতপাদন হত এবং নিষ্কাসন এর পরে নানা জায়গায় তামা রপ্তানি হত। আজও এই অঞ্চল থেকে তামা উত্তোলন হয় এবং সেই সময়ের খনি পাওয়া যায়। এই তামা রপ্তানির মূল বন্দর ছিল তাম্রলিপ্ত। শুধু তামা রপ্তানির জন্য নয়, পচন রক্ষা থেকে বাচানোর জন্য জাহাজের কাঠের খোলে তামা লেপে দেওয়া হত (মতান্তরে তামার পেরেক মারা হত) এই বন্দরে। তাই নাম ছিল তাম্রলিপ্ত, এখান থেকেই রাজার নামও হয় তাম্রধ্বজ।
আবার পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই মতের সাথে একমত হতে পারেন না। তার মতে তাম্রলিপ্ত সংস্কৃতি নাম,এর আগে নাম ছিল দামালিপ্ত অর্থাৎ দামল বা তামিল জাতির নগর। তার মতে চন্দ্রগুপ্তের বহু আগে তামিলরা যে বংগদেশে বাস করতেন,তার প্রমাণ আছে এবং তারা নৌকাবিদ্যায় পটু ছিল। সেই সময় থেকেই তাম্রলিপ্ত বড় বন্দর ও বাণিজ্য নগর। ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সেন এই দাবীর সাথে একমত হয়ে বলেছেন মেদিনীপুর জেলা থেকে 'দামল' জাতিই দক্ষিণ দেশে গিয়ে তামিল নামে পরিচিত হয়েছে। প্রসংগত তাম্রলিপ্তি পালি ভাষায় তামলিপটি লেখা হত,সেখান থেকেও তামিল শব্দটা আসতে পারে।
পন্ডিত কনকভাই এর মতেও মংগোলিয়ান উপজাতিরা ভারতবর্ষে এসে প্রথমে গংগার মোহনায় তামালিত্তি নামে শহর বন্দর গড়ে তোলে,পরে তারা আরও দক্ষিণে চলে যায় ও তামিল নামে পরিচিত হয়।
তবে এই শহরের নাম কোথাও পাওয়া যায় তমোলিপ্ত নামে। তমঃ অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন, লিপ্ত অর্থাত আচ্ছন্ন।
স্থানীয় লেখক ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিতের মতে সম্ভবত হিন্দু ধর্মের পূর্বে দীর্ঘদিন যাবত তাম্রলিপ্তি বৌদ্ধদের (মতান্তরে অনার্যদের) হাতে ছিল,তাই হিন্দুরা বিকৃত করে এর ঘৃণাসূচক নাম রাখে তমোলিপ্ত। পরে যখন তাম্রলিপ্ত হিন্দুদের হস্তগত হয় তখন ব্রাম্ভ্রণ ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্গত হয়। পুরাণের গল্পে এর উল্লেখ রয়েছে, বিষ্ণু কল্কিরূপ ধারণ করে অসুরদের ধ্বংস করে, সেই সময় যুদ্ধাশ্রমে শরীরের ঘাম বের হয়ে মাটিতে পড়লে তাম্রলিপ্ত তার পূণ্যতা অর্জন করে। আজ আবার সুকুমার সেন সহ  অনেক ঐতিহাসিক,ভাষাবিদের মতে অষ্ট্রোলয়েড জাতির আদি বাসিন্দাদের অসুর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে পুরাণে।
সমুদ্রপাড়ে অবস্থিত বলে কোথাও এর নাম বেলাকূল বা বেলাকূলং। আবার চীনা পরিব্রাজকদের লেখায় এই নাম পাওয়া যায় তন্মোলিতি বা তমোলিতি।
এবারে আমরা পাড়ি দেবো তমলুকের ইতিহাসে,ফলো করতে থাকুন আমাদের পেজ, ব্লগ।

রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

বহুনামে তমলুক

কত নামে চেনা যায় একটা শহরকে? ধরা যাক তমলুকেরই উদাহরণ। কিছুদিন আগে অব্দিও নাম ছিল তমোলুক, তারও আগে তম্বুলক
আর আমরা যদি একটু উকি মারি প্রাচীন সময়ে অর্থাৎ ১৪০০ সালের পূর্বে?
মহাভারতে সংস্কৃত নাম ছিল তাম্রলিপ্ত
ভারতকোষে তাম্রলিপ্তি
শব্দরত্নাবলীতে নাম ছিল তমোলিপ্ত (অন্ধকারে আচ্ছন্ন)।
ত্রিকান্ডশেষ নামক প্রাচীন অভিধানে এই জায়গার নাম ছিল বেলাকূল, তাম্রলিপ্ত, তাম্রলিপ্তিতমালিকা
দ্বাদশ শতাব্দীরর লেখক হেমচন্দ্র সুরির অভিধান চিন্তামণিতে নাম দামলিপ্ত, তমালিনী, বিষনুগৃহ
শব্দকল্পদ্রুম নামক সংস্কৃতি অভিধানে  তমোলিপ্তি

প্লিনির বর্ণনায়  (খ্রীষ্টাব্দ প্রথম শতক)তমলুকের নাম তালুকেট।

গ্রীক পন্ডিত টলেমীর (খ্রীষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতক) বর্ণনায় এই জায়গাটির নাম রয়েছে তামালিটি (Tamalities).

প্রেমময় দাশগুপ্ত সংকলিত বংগানুবাদ অনুসারে বার্মা উপকথায় বর্ণিত এজেত্তা (Adzeitta) বন্দর আসলে তাম্রলিপ্ত বন্দর।
মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বৈশালী শহরে আনন্দ চন্দ্র শিলালিপিতে এই শহরের নাম উল্লেখ আছে তাম্রপাট্টানা নামে।
চীনা পরিব্রাজক হিউ এন সাং তমলুককে বর্ণণা করেছিলেন তন্মোলিতি বা তমোলিতি (Tan mo liti) নামে।
আসলে তমলুকের বয়স তো কম হল না, সেই প্রাক সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে শুরু করে বৈদিক সভ্যতা, বৌদ্ধযুগ, হিন্দুসাম্রাজ্য, মুসলিম শাসন, ইংরেজ উপনিবেশ হয়ে আজকের সময়, বহু ইতিহাসের উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছে এই তমলুক।
নামকরণ এর ইতিহাস, বিবর্তন, বিবরণ নাহয় জানা যাবে অন্য কোনো লেখায়। ফলো করতে থাকুন আমাদের ব্লগ ও পেজ।

এখনো অব্দি আমরা এই ব্লগ লিখতে যে সমস্ত বই এর সাহায্য নিয়েছি

১. মেদিনীকথা পূর্ব মেদিনীপুর
     -অরিন্দম ভৌমিক
২. তমোলুক ইতিহাস
      - শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত
৩. ইতিহাস ও কিংবদন্তিতে দেবী বর্গভীমা
      -ডঃ প্রদ্যোত কুমার মাইতি
৪. তমলুকের ইতিহাস
      -সেবানন্দ ভারতী
৫. তমলুকের সেকাল একাল
     -জয়দীপ পন্ডা
৬. অনন্য মেদিনীপুর
      -ডঃ প্রদ্যোত কুমার মাইতি
৭. প্রাক-ইতিহাস
      -ইরফান হাবিব
৮. আর্য রহস্য
       -সুহৃদকুমার ভৌমিক
৯. www.roseboshe.com
        -তথাগত দাশমজুমদার

বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১৬

তমলুকে কালী পূজো

ব্লগে প্রথম লেখা,কি নিয়ে শুরু করা যায় ভাবছিলাম, ঘটনাক্রমে পড়ে গেল কালীপূজো। তমলুকের আজও যেকয়টি কারণের জন্য সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে,তার মধ্যে কালীপূজো একটি। গোটা তমলুক শহর জুড়ে অন্তত ৭০টি বড় পূজো হয়, আশেপাশের গ্রাম শহর থেকে ধর্মনির্বিশেষে লোকেরা ভীড় জমায় এই তমলুক শহরে,টানা চারদিন ধরে সারারাতব্যপী চলতে থাকে এই কালীপূজোর উৎসব।
অথচ দীর্ঘকাল এই প্রাচীন শহরে কোনো কালীপূজো এমনকি দূর্গাপূজোও হয়নি। কথিত আছে শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বর্গভীমা সতীর একান্নপীঠের এক অংশ। তাই শহরে (পায়রাটুঙির খাল থেকে শংকরআড়া খাল) অন্য শক্তির পূজো অর্থাৎ দশমহাবিদ্যার(মতান্তরে ২৭ টি শক্তি) আরাধনা নিষিদ্ধ ছিল।
তাহলে কারা শুরু করলো তমলুকে কালীপূজো? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম আবাসবাড়ির ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবে। শহরের একপ্রান্তে ঐতিহাসিক বাণপুকুরের পাশে দোতালা ক্লাব, প্রতিষ্ঠা ১৯৪২ সালে,প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আর পাঁচটি ক্লাবের মতই ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য। শুনেছিলাম পায়রাটুঙির ভাঙন এর হাত থেকে আবাসবাড়িকে বাঁচাতে শক্তির আরাধনা শুরু হয়েছিল,যেমনভাবে মানুষের বিশ্বাস দেবী বর্গভীমা যুগ যুগ ধরে রূপনারায়নের হাত থেকে তমলুক শহরকে রক্ষা করে এসেছে। তবে ক্লাবের সদস্যরা সেই গল্পকথা উড়িয়ে দিলেন, বললেন নিছক দুঃসাহসিকতার বশেই ততকালীন সদস্যরা কালীপূজো শুরু করেছিলেন,১৯৫২ সালে। তখন আবাসবাড়ি প্রায় পুরোটাই ছিল ঘন বাঁশঝাড়ে ঢাকা,যেখানে দিনের বেলাও লোকে একা পেরোতে ভয় পেতো,তমলুক মর্গটাও তখন এখানেই ছিল! বিরোধিতাও এসেছিল ভালোমতই, তমলুকবাসীরা পরের একবছর নাকি ভয়ংকর কিছু ঘটার দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছিল,তবে যখন কিছু হল না, পুরোদমেই কালীপূজো শুরু হয় দিকে দিকে। অবশ্য ক্লাবের শুরু করে যাওয়া নিয়ম এখনো চলে আসছে গোটা টাউন জুড়েই, কালীপূজো শুরু করার আগে দেবী বর্গভীমার অনুমতি নিতে হয়, সেই উপলক্ষে সমস্ত পূজোরই জমকালো শোভাযাত্রা বেরোয়। যদিও আগের মত শাড়িপরিহিতা মহিলাদের শোভাযাত্রা আর দেখা যায় না।
সেইসময় এরপর ধীরে ধীরে কালীপূজো শুরু হয় বয়েজ স্পোর্টিং ক্লাব, হরির বাজারের পূজো,কল্পতরু, টিএফসি ক্লাবের হাত ধরে। তমলুকে দূর্গাপূজোও ১৯৫৬ সালে প্রথম শুরু করে এই ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবই।
তবে এখনো থিম নিয়ে মাথা ঘামাননা এই প্রাচীন পূজো উদ্যোক্তারা। উত্তরায়ণ ক্লাবের এক উদ্যোক্তার মতে নব্বই এর দশকে প্রথম থিম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা তারাই করেন। আজকের সময়ে তমলুকে থিম জনপ্রিয় করে তোলে চলন্তিকার পাশে স্টেল্লারোসা ক্লাব, পুরনো রাজবাড়ির আদলে প্যান্ডেল তৈরি হয়েছিল, তারপর ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে থিম পূজো। তবে আজকে থিম পূজোয় নিজস্বতার খুব অভাব,মূলতঃ কোলকাতার বিভিন্ন দূর্গাপূজোর থিমই নিয়ে আসা হয়। অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই,তা নয়, এদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী গৌরাংগ কুইলাও রয়েছেন, এমনকি বিখ্যাত শিল্পী সনাতন দিন্দার প্রথম কাজ ছিল এই তমলুক শহরেই।
(চলবে)
অভিষেক তুঙ্গ
সহযোগীতায় অনির্বাণ সেনাপতি